Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিল্প ও বাণিজ্য

শেরপুরের শিল্প ও বাণিজ্য

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংরেজ আমল শুরুর পূর্ববর্তী সময়ে শেরপুরের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প সম্পর্কে নয়আনীর জমিদার শ্রী হরচন্দ্র চৌধুরী রচিত ও ১৩৬ বছর আগে প্রকাশিত ‘শেরপুর বিবরণ’ বইয়ে কিছু প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়। তার গ্রন্থেও সেসময়ে এতদঞ্চলের শিল্প ও বাণিজ্য কৃষিভিত্তিক ছিল তার প্রমাণ মেলে। শুরুতেই গ্রন্থকার লিখেছেন, ‘‘কৃষিকার্যই অধিকাংশ লোকের প্রধান উপজীব্য’’। এ গ্রন্থে তখনকার কৃষকদের চাষপদ্ধতি ও উৎপাদিত ফসলের বিবরণ রয়েছে। সে সময় চাষীরা ‘বাতর’ বা ‘আল’ বেঁধে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ, নালা কেটে পানি নিষ্কাশন করতো। সেচের পানি যোগান দেয়ার জন্য ‘দোন’ ব্যবহার করতো। জমিতে সার হিসেবে গোবর, খৈল, জৈবিক সার ও ছাই প্রয়োগ করতো। সেসময় সমতল এলাকার চাষীরা বাওয়া (আমন), বোরো ও আশু (আউশ) ধান, চিনা, কাওন, কোষ্টা (পাট) সর্ষপ (সরিষা), তিল, খেসারি, মটর ও মুসুর ডালের আবাদ করত। পাহাড়ি এলাকায় উঁচুভূমিতে বসবাসকারী উপজাতি-আদিবাসীদের দেওধান্য, মাক্কু (ভুট্টা), বিন্নিকচু ও কার্পাস প্রধান উৎপন্ন ফসল ছিল। সে সময় ডালু অঞ্চলে উন্নত মানের কার্পাস তুলা উৎপাদিত হতো। এছাড়া পাহাড়ি এলাকায় তারাই বাঁশ, তেজপাতা, পচাপাতা (ঔষধী) ও নানা প্রজাতির কাঠ জাতীয় বৃক্ষ সহজলভ্য ছিল। আর এসময় উৎপাদিত ফসল, বাঁশ ও কাঠ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি হত।

 

রপ্তানিকৃত কৃষিপণ্যের নাম ও স্থানঃ

সেসময় শেরপুর থেকে সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, কলকাতা, রংপুর, হোসেনপুর ও কাগমারী তে যেসব পণ্য রপ্তানি হতো, সেসবের মধ্যে ধান, চাল, কোষ্টা (পাট), সরিষা, তিল, কার্পাস, কাঁঠাল, গজদন্ত (হাতীর দাঁত), উল্লেখযোগ্য। আমদানি পণ্যের মধ্যে ছিল লবণ, সুপারী, নালী, গুড়, চিনি, তামাক, কাপড়, বাসন, মশলা, মনোহারী দ্রব্য, সোনা-রূপার অলংকার, পাটনাই মটর বুট, পান, বই, কাগজ, গোধুম (গম), চুন, শীতলপাটী, কমলা, শুঁটকী মাছ ইত্যাদি।

যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ

এসময় যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত ছিল। ক্ষেতের আল বা গোবাট দিয়েই লোকজন প্রধানতঃ যাতায়াত করত। তবে তখন আসামের গোয়ালপাড়া, পিয়ারপুর ও জামালপুরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ছিল। নদীপথেও যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। পণ্য পরিবহণের জন্য সেসময় গরু বা মহিষের গাড়ি, মুটে এবং নৌকার ব্যবহার ছিল।

 

বাণিজ্যিক কেন্দ্রঃ

প্রাচীনতম জনপদ শেরপুরের সীমানা সেসময় বর্তমানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছিল। বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার ফুলপুর, হালুয়াঘাট, দুর্গাপুরের কিছু অংশ, জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ এবং দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কিছু অংশ শেরপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ বিস্তৃত এলাকায় সেসময় অনেকগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। সপ্তাহের বিভিন্নদিনে এখানে হাট বসত। সেখানে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করা হত। এ পরগণার উলে­াখযোগ্য হাটবাজারগুলো হচ্ছে গোবিন্দগঞ্জ (তিনআনী), ঘোষগাঁও, গিলাগাছা, মাদারগঞ্জ, কুরুয়া, গাজীরখামার, নকলা, রৌহা, ভীমগঞ্জ, চন্দ্রকোনা, মুন্সীর হাট (কৃষ্ণগঞ্জ), ঝিকুর হাট, বাড়ই কান্দি, সুতার পাড়, শ্রীবরদী শম্ভুগঞ্জ, রাজগঞ্জ, মালিঝিকান্দা, নন্নী, ভায়াডাঙ্গা, জিরাইগাতি (ঝিনাইগাতি বা কোদালজানী), রানীশিমুল, পাইকুরা, তন্ত্র (কামারপাড়া), হাতিপাগাড়, বালুঘাট, তারাগঞ্জ, মানিকপাড়া, শিমুলতলী, কৈয়েরহাট, হালুয়াঘাট, ধারা, লাউচাপড়া প্রভৃতি। এসব বাণিজ্যিক কেন্দ্রের অনেকগুলো এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা নাম পরিবর্তিত হয়েছে। এছাড়া পাহাড়ী হাটবাজারে সেসময় বিনিময় প্রথার মাধ্যমেও পণ্যের লেনদেন চালু ছিল। উপজাতি আদিবাসী লোকজন বাঁশ, কাঠ, কার্পাস তুলা, পচাপাতা, তেজপাতার বিনিময়ে ধান, চাল, লবন, তামাক, তৈজসপত্র, শুঁটকী মাছ ও গৃহপালিত মোরগ-মুরগী গ্রহণ করতো।

শিল্পঃ

শেরপুরের শিল্পের অবস্থা এসময় খুবই নাজুক ছিল। শিল্পের বিকাশ বা উৎকর্ষতা কিছুই ঘটেনি। বয়নশিল্প সহ যেসব কুটিরশিল্প ছিল তা ছিল খুবই নিম্নমানের। তন্তুবায়ীরা (যোগী) যে কাপড় তৈরী করত তা খুবই মোটা দাগের। এসময় ‘‘এন্নিকীটের’’(এন্ডি) সুতার কাপড় তৈরি হত। কিন্তু সেগুলো মোটেও মিহি ও মসৃণ হতো না। উপজাতীয়রা জাজর, বেটি, পাটনি নামে হাতে বোনা বিভিন্ন জাতের মোটা কাপড় তৈরি করত। কাপালিকরা চট বা ছালা এবং গারো সম্প্রদায় সোপাঙ্গ গাছের ত্বক (ছাল) পিটিয়ে ‘‘সাপাঙ্গের খাল’’ নামে এক ধরণের কাপড় বুনতো। এছাড়া মুসলমান ও হাজং সম্প্রদায়ের কিছু লোকজন সোনা-রূপার অলংকার তৈরি করত। তাদের তৈরি অলংকারগুলো ছিল সাদামাটা, তারা ফাঁপা অলংকারের উপর নকশার কাজ করতে পারত না। এসব শিল্পী তখন সোনারু নামে পরিচিত ছিল। তবে গারোদের তৈরী লোহার দা ও কাসার খোড়া (এক ধরনের বাটি) সেকালের বিবেচনায় খুবই উন্নতমানের ছিল। তবে এসব শিল্প সামগ্রী বাইরে রপ্তানি হতো কিনা সে ব্যপারে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। অপরদিকে শেরপুরের ভীমগঞ্জ ও কামারের চরে নীল চাষ হতো। এখানে নীল তৈরির সরঞ্জাম ও নীলকর সাহেবদের কুঠিবাড়ীর নিদর্শন দেখা গেছে। ১৮৬৯ সালে শেরপুর পৌরসভা স্থাপিত হবার পর ১৮৭২ সালে নীলচাষ ও নীলকরদের অত্যাচার পুরোপুরি রোহিত হয়।

 

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ বাংলার রাজনৈতিক সমাজ জীবনে এক বিরাট পরিবর্তনের যুগ। এসময় এতদঞ্চলে মুসলমান আমলের অবসান ঘটে এবং ইরেজ শাসন শুরু হয়। ইংরেজদের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন জারীর ফলে জমিদারী প্রথা পাকাপোক্ত রূপ ধারণ করে। এ যুগসন্ধিক্ষণে এ অঞ্চলে নানা ধরনের বিদ্রোহ ও সংগ্রামের সূচনা ঘটে। এর মধ্যে ফকির বিদ্রোহ, বক্সার বিদ্রোহ, টিপু পাগলের বিদ্রোহ, জানকু পাথরের বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। যদিও এসকল বিদ্রোহ বা সংগ্রাম সফল হয়নি। তবুও স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে এর প্রভাব পড়েছিল। তবে এ প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

 

ইংরেজ শাসন আমলের শুরুতেই শেরপুরের সঙ্গে তদানীন্তন ভারত উপমহাদেশের পীঠস্থান কোলকাতার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র গড়ে উঠায় এখানে দ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে উন্নত প্রযুক্তি ও যোগাযোগের বিকাশ ঘটে। কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণে স্থানীয় কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষেরা পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে বাংলা ১৩৩৬ সালে প্রকাশিত শ্রী বিজয় চন্দ্র নাগ লিখিত ‘নাগ বংশের ইতিবৃত্ত’ বইয়ে ‘‘ক্রমেই শ্রমজীবীগণ দরিদ্র ও নিঃস্ব হইয়া পড়িতেছে’’ বাক্যটি প্রণিধানযোগ্য।

পূর্বেই বলা হয়েছে জমিদার আমলের সূচনালগ্ন থেকেই শেরপুরের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ হতে শুরু করে। এসময় বিক্রমপুর তথা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থান থেকে বহিরাগতরা এখানে এসে বসতি গড়ে তোলে। তাদের হাতেই এ অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পের কর্তৃত্ব চলে যায়।

 

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে এখানে আমদানি-রপ্তানির প্রসার ঘটে এবং নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এসময় শেরপুরে বয়ন শিল্পের উৎকর্ষকতা বৃদ্ধি পায়। চকবাজার এলাকায় উন্নত মানের কাপড় তৈরির তাঁতশিল্প, গৃর্দানায়ণপুর এলাকায় দিয়াশলাই (ম্যাচ) ফ্যাক্টরি, রঘুনাথ বাজার এলাকায় (বর্তমান আনসার ক্লাব) ক্ষুর, কাঁচি, ছুরিসহ বিভিন্ন ধরনের লৌহজাত পণ্যের কারখানা, মুন্সীবাজারে দুইটি লেমন সোডা ওয়াটার প্রস্তুত কারখানা, ছাতা তৈরির কারখানা, শীতলপুর ও বয়রা এলাকায় দুইটি পোড়ামাটির টালি ফ্যাক্টরি এবং টিন ও স্টিলের ট্রাঙ্ক ও বাক্স তৈরির কারখানা গড়ে উঠে। এসময় কুটিরশিল্পে শৈল্পিক উৎকর্ষতা ও প্রসার লাভ করে। এখানে হাতীর দাঁতের তৈরি চেয়ার, পাটি, খড়ম, মহিষের শিং-এর চিরুনী, বিভিন্ন ধরনের কৌটা, খড়মের বলুয়া তৈরি হত। এখানের কাঠের তৈরি খড়মের খুবই সুখ্যাতি ছিল। এ প্রসঙ্গে শ্রী কেদারনাথ মজুমদার তাঁর ‘ময়মনসিংহের বিবরণ’ বই-এ লিখেছেন, ‘‘সেরপুরের কাষ্ঠ পাদুকার নতুনত্ব আছে’’। এ প্রসঙ্গে সে সময়কার একজন খড়ম শিল্পীর কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়নের জিন্নত আলী সুতার নামে একজন কারিগর মুক্তাগাছার মহারাজের জন্য একজোড়া খড়ম তৈরি করে দিয়েছিলেন। সেই খড়মের সৌন্দর্যে মহারাজা এতই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন যে, খড়ম প্রস্ত্ততকারককে সাত কাঠা জমি দান করেছিলেন। তার অধস্তন পুরুষেরা এখনও বেঁচে আছেন।এ আমলে শেরপুরে বাঁশবেতের কাজেরও উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। অপরদিকে স্থানীয় জমিদার তালুকদারদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বহিরাগত স্বর্ণকার, কাঁসারু, গোয়ালাদের আগমনের ফলে এখানে অলংকার, কাঁসা-পিতলের বাসন এবং মিষ্টান্ন শিল্পের বিকাশ ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে।

 

সে সময় শেরপুরের ব্যবসা-বাণিজ্যের এত প্রসার ঘটে যে এখানে এগারোটি ব্যাংক ও লোন অফিস স্থাপিত হয়। জমিদার আমলে শেরপুরের আমদানি-রপ্তানি পণ্য সম্বন্ধে নাগবংশের ইতিবৃত্ত বই থেকে জানা যায় এখানে উল্লেখযোগ্য আমদানি পণ্যের মধ্যে সিরাজগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ থেকে চিনি, নালী, গুড়, সুপারী, লবণ, বুট(ছোলা), খেসারী, মটর, মুসুরী, কাগমারী থেকে তাঁতের কাপড়, ঢাকা থেকে সাজ, মসল­া, বানিয়াতি ও আর্য়ুবেদিক গাছ-গাছড়া ঔষধ, কোলকাতা থেকে কাপড়, লোহা, সিমেন্ট, ছাতক থেকে পাথর চুন, পাবনা থেকে পান এবং জাফর শাহী ও পাতিলাদহ থেকে মাছ এবং নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ থেকে শুঁটকীমাছ আমদানি করা হতো। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল ধান, চাউল, ঘৃত, সরিষা, কার্পাস, পাট, বেতের তৈজসপত্র, তামাক, খড়ম, শুকনো মরিচ, তাড়াই বাঁশ উল্লেখযোগ্য। পাঠকের অবগতির জন্য ‘নাগ বংশের ইতিবৃত্ত’ বইয়ে উল্লেখিত ৮০ বৎসর আগে ১৯২৮ সনের শেরপুরের কিছু পণ্যের প্রতিমণের (৪০ কেজি) দাম তুলে ধরা হলো, আতপ চাল- ৮ টাকা, মুগডাল- ১০ টাকা, খেসারী- ৫ টাকা, লবণ- ৩ টাকা, তেল- ২৩ টাকা, চিনি- ১২.৫০ টাকা, গুড়- ৭.৫০ টাকা, আটা- ১০ টাকা, দুধ- ১০ টাকা, ঘি- ১২০ টাকা, তামাক- ২০ টাকা এবং ‘অবাক’ ও ‘মনোরঞ্জন’ নামে দু’প্রকার মিষ্টান্ন ৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতো। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ‘অবাক’ ও ‘মনোরঞ্জন’ নামে মিষ্টান দুটি বর্তমানে স্থানীয়ভাবে তৈরী মিষ্টান্নের তালিকা থেকে হারিয়ে গেছে। এ মিষ্টান্ন দুটো সম্মন্ধে স্থানীয় মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের কাছে এর প্রস্ত্ততপ্রণালী তো দূরের কথা নামও অজ্ঞাত। অথচ তখন এ মিষ্টান্ন দুটি অন্যান্য মিষ্টির তুলনায় অভিজাত ও মহার্ঘ ছিল।

জমিদার আমলে শেরপুরের হাট-বাজার ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে রাজগঞ্জ, কোটের হাট, জিরাইগাতী, ভায়াডাঙ্গা, ডালুর হাট, শম্ভুগঞ্জ, নালিতাবাড়ী, হাট তারাগঞ্জ, হালুয়াঘাট, মুন্সীরহাট, গোপালগঞ্জ ও কাশীগঞ্জ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শেরপুর পৌর এলাকায় নয়আনী, আড়াইআনী ও তিনআনী জমিদারদের প্রতিষ্ঠিত রঘুনাথ, তেরা, নয়আনী ও তিনআনী- এ চারটি বাজারে সপ্তাহের ৭ দিনই পর্যায়ক্রমে হাট বসত। এ সম্পর্কে একটি ছড়া প্রচলিত ছিল। ছড়াটি হচ্ছেঃ

সোম শুক্র রঘুনাথ,

শনি মঙ্গল তেরা,

রবি বৃহস্পতি নয়আনী,

একলা বুধ তিনআনী।

জমিদারদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শেরপুরের ব্যবসাবাণিজ্য ও শিল্প বিকাশে যেমন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল তেমনি তৎকালীন জমিদার, তালুকদার ও সামন্ত প্রভুদের কর বা খাজনা আদায়ের নামে কিংবা ভোগবিলাস চরিতার্থ করার জন্য সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার ও অবিচারের কালো অধ্যায়ের ইতিহাসও রয়েছে।

 

পাকিস্তান আমলঃ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি, ইংরেজ শাসনের অবসান এবং দেশ বিভক্তির ফলে ১৯৪৭ সালের পর থেকে শেরপুরের ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে চরম স্থবিরতা নেমে আসে। এ সময় জমিদার, শিক্ষিত অভিজাত সম্প্রদায়, হিন্দু ব্যবসায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের দলে দলে দেশত্যাগের কারণে অর্থনৈতিকসহ সকল ক্ষেত্রে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।

 

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ সময়েও এ স্থবিরতা দূর হয়নি। উল্লেখযোগ্য কোন শিল্প প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেনি। দীর্ঘ ২৪ বৎসরের পাকিস্তানী আমলে এখানে কিছু পাকা রাস্তা ও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠাই একমাত্র উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি। এছাড়া ১৯৬৪ সনে এখানে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে ওঠা ও টেলিফোন এক্সেঞ্জ স্থাপন হচ্ছে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে ১৯৫৮- ৫৯ সালে গারো পাহাড় এলাকায় খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণের উদ্দেশ্যে ‘‘মাইনিং কোম্পানি’’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। প্রচার করা হয় পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর বোল্ডার, চিপস্সহ নানাধরনের নুড়ি পাথর, হোয়াইট ক্লে এবং চশমার কাঁচ প্রস্ত্তত করার জন্য অতি প্রয়োজনীয় সিলিকা স্যান্ড মজুদ রয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন জরিপ না করেই কোম্পানিটি নির্বিবাদে পাহাড় ধ্বংস করে পাথর উত্তোলন শুরু করে। ১৯৬৫ সালের শেষদিকে কোম্পানিটি তাদের উদরপূর্তি করে এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেয়। কিন্তু ঐ কোম্পানিটি পাহাড়ের পরিবেশ ধ্বংসকারী যে কাজটি শুরু করে ছিল আজো তা অব্যাহত রয়েছে। অপরদিকে ষাটের দশকে বিড়ি শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল টেন্ডুপাতা ভারত থেকে আমদানি নিষিদ্ধ করা হলে ঝিনাইগাতী উপজেলার নকশী অঞ্চলে কুম্ভিপাতা সংগ্রহ ও প্রসেসিং করার কারখানা গড়ে উঠে। এটা স্থানীয়ভাবে পাতার ক্যাম্প বলে পরিচিতি লাভ করে। এখানে বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। ১৯৬৮ সালের দিকে বনাঞ্চলে কুম্ভিপাতার অভাব দেখা দিলে ক্যাম্পটি বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঐ পাতার ক্যাম্পটি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসময় কয়েকটি বিড়ি ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী ‘ঢেঁকিছাটা চাউল’ শিল্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ড্রাম ব্রয়লার গড়ে উঠতে শুরু করে। তখনও এখান থেকে রপ্তানির তালিকায় শুধু ধান, চাল ও পাটই প্রধান পণ্য ছিল। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ইষ্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশন ও কৃষি ব্যাংক এ তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন পরিচালিত হত।

 

স্বাধীনতা উত্তর শেরপুরঃ

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বর্বর পাকিস্তানীবাহিনী ও তার এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ বাহিনীর অনুসৃত পোড়ামাটি নীতির কারণে শেরপুরের শিল্প ব্যবসা বাণিজ্যসহ সকল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরপরও শেরপুরবাসী ভেঙ্গে পড়েনি। নবউদ্যমে ব্যবসা বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে ব্রতী হয়। এরই ধারাবাহিকতায় খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত বলে পরিচিত শেরপুরের ভেঙ্গে পড়া কৃষির পুনর্গঠনের সাথে সাথে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর ফলে এ এলাকায় ড্রামবয়লারের চালকল গড়ে উঠতে শুরু করে। সেই সাথে সত্তুর দশকের প্রথমদিকেই দু’টি মেজর রাইসমিল (স্বয়ংক্রিয়) প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়।

 

কিন্তু ১৯৭৪ সালে সর্বনাশা বন্যার কারণে সৃষ্ট আকাল, ’৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার মত নির্মম ঘটনায় শেরপুরের শিল্প স্থাপনে এবং ব্যবসা বাণিজ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তবে জীবন থেমে থাকেনি। ১৯৭৮ সনে শেরপুর মহকুমায় উন্নীত হওয়ায় (১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর বঙ্গবন্ধু শেরপুরকে ৬১তম জেলা ঘোষণা করেছিলেন) এখানে ব্যবসা বাণিজ্যে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। এসময় বিসিক শিল্প নগরী স্থাপনের কাজ শুরু হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে গৌরীপুরে মুক্তিযোদ্ধা উইভিং ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু পরিচালকদের অনভিজ্ঞতা ও দুর্বলতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯৮১ সনে সেনা বিদ্রোহে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হলে স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পে মন্দাভাব দেখা দেয়।

 

পরবর্তিতে প্রেসিডেন্ট এরশাদ আমলে শেরপুরকে জেলায় উন্নীতকরণ এবং জেলায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও উপজেলা পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য ও শিল্পে ব্যপক গতি সঞ্চারিত হয়। আশির দশকের শেষ দিকে এসে ’৮৮ এর বন্যা, দলীয় নেতা কর্মীদের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ৯০- এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ৯৬-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নয়নের গতিতে ধাক্কা লাগলেও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়নি। আশির দশক থেকে শুরু করে দীর্ঘ দুইযুগে জেলার উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, পানি, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় দ্রুত শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছে। জেলার প্রধান শিল্প হিসেবে চালমিলই উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে জেলায় চারটি স্বয়ংক্রিয় মেজর রাইস মিল, আটটি অটো রাইসমিল সহ প্রায় ছয়শত চালকল রয়েছে। এসব মিলে প্রায় পনের হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। জেলায় একটিমাত্র বিড়ি ফ্যাক্টরি ও তার শাখা রয়েছে, এখানেও প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় গারো পাহাড় এলাকায় দু’টি রাবার বাগান ও প্রসেসিং কারখানা গড়ে উঠেছে। এরমধ্যে ঝিনাইগাতীতে বেসরকারি রাবার বাগানটি বর্তমানে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলেও শ্রীবরদীতে বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের রাবার বাগানটি এখনো লাভের মুখ দেখেনি। শেরপুরে তিনটি ডেইরী ফার্ম, ৩৫৪টি পোলট্রি ফার্ম রয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ টি লেয়ার ফার্ম এবং ২৯৮ টি ব্রয়লার ফার্ম। এছাড়া জেলার বিপুল সংখ্যক পুকুরে বর্তমানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছের চাষ হচ্ছে। দমদমা কালীগঞ্জ এলাকায় পনের একর জমির উপর গড়ে ওঠা বিসিক শিল্প নগরীতে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য ৫৫টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, এর মধ্যে দশটি প্লটে শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে এবং অন্যান্য প্লটে অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে সেখানে যে দশটি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সোয়েটার কারখানা, দু’টি রাইসমিল, ফিস ফিড কারখানা, সাবান, টুথপাউডার, মসলা ও মুড়ি প্রস্ত্ততকারী কারখানা।

 

জেলার অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে চাহিদার তাল মিলিয়ে এখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে অর্ধশত ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এছাড়া স্টিল ফার্নিচার তৈরির কারখানা, জানালা দরজা সাটারসহ বিভিন্ন গেট তৈরির ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চালমিলের উপজাত ‘তুষ’ থেকে ‘চারকল’ নামে একধরনের জ্বালানী লাকড়ি তৈরী হচ্ছে যা কাঠের লাকড়ির বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া বীজআলু সংরক্ষণের জন্য একটি হিমাগার স্থাপিত হয়েছে। অপরদিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শেরপুরের সর্বত্র নার্সারী বাগান দ্রুত প্রসার লাভ করেছে। সদর উপজেলার বয়রা গ্রামে একটি ‘নার্সারী পল্লী’ই গড়ে উঠেছে। নালিতাবাড়ীতে ‘অবকাশ’ নামে একটি নার্সারী প্রতিষ্ঠান ফুল, ফলদ ও কাঠজাতীয় বৃক্ষের চারা ভ্রাম্যমান যানে করে জেলার বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করছে।

 

১৯৯৬ সনে আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে নাকুগাঁও স্থলবন্দর স্থাপন ঐ সরকারের উল্লেখযোগ্য অবদান। এ স্থলবন্দর থেকে প্রতি বছর মোটা অংকের রাজস্ব আয় হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানি খাতে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে এ স্থলবন্দর থেকে ৭ কোটি ৬৭ লাখ ৫৭ হাজার টাকা এবং ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে ৮ কোটি ৫৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এছাড়া উল্লেখিত দু’বছরে ২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ভ্রমনকর আয় হয়েছে। স্থলবন্দরটির কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা হলে এখান থেকে আরো অধিক পরিমাণে রাজস্ব আয় হবে বলে স্থানীয় আমদানি-রপ্তানিকারকদের অভিমত। অপরদিকে জেলার সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্র ‘অবকাশ পিকনিক স্পট’ ও ‘মধুটিলা ইকোপার্ক’ থেকেও কিছু রাজস্ব আয় হচ্ছে।

উপসংহারঃ

জেলার চালমিলই প্রধান শিল্প এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিপুল সংখ্যক চালমিল থাকা সত্ত্বেও প্রতি বছর ফসলের জমি ধ্বংস করে, পরিবেশের তোয়াক্কা না করে, চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে নতুন নতুন চালমিল গড়ে উঠছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে অনেকের কাছে এর ফলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে মনে হলেও এ শিল্প স্থাপনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ প্রয়োজন্ অন্যথায় বিপর্যয় নেমে আসবে। প্রতিষ্ঠিত চালমিলগুলো টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই এশিল্প সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জরিপ ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে শুধুমাত্র এ শিল্পের উপর নির্ভরশীল না থেকে সীমান্তবর্তী পাহাড়ী এলাকায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি স্থাপন করা প্রয়োজন, এর ফলে ঐ এলাকায় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। যারা পরিবেশ ধ্বংস করে পাহাড় কেটে নুড়ি পাথর উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করছে তারা কাজের সুযোগ পাবে। অপরদিকে ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় শিমুল আলু (কাসাবা) চাষ হয়। এ আলুকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে এখানে মিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারে। এ আলু থেকে গ্লুকোজ, ট্যাপিওকা বা ব্রাজিলিয়ান এরারুট প্রস্ত্তত করা যায়।

এছাড়া পাকিস্তান আমলে গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ৩০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক নির্মাণের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল সেটার কাজ নতুন করে শুরু করে দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। এর ফলে দীর্ঘ সীমান্ত সড়ক পথের বিভিন্ন স্থানে পর্যটন শিল্প গড়ে উঠতে পারে। এ থেকে ঐ এলাকাবাসীদের যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে তেমনি রাজস্ব আয়ের পথও উন্মুক্ত হবে।